অনামিকা দেখতে মোটেও সুন্দরী ছিলনা, তবে চোখে তার যাদুর মায়া ছিল। অনন্তও দেখতে তেমন সুদর্শন ছিলনা, তবে তার একটা নরম মন ছিল, চেহারায়ও বেশ একটা ভব্যতা প্রকাশ পেত। অনামিকা সুবক্তা ছিল, অনন্ত সুশ্রোতা। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে অনামিকা কথা বলে যেত, অনন্ত মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যেত। কথার মাঝে মাঝে যদি অনামিকা শুধাতো, ‘তুমিও কিছু বলো!’, তখন অনন্ত কিছুটা চমকে উঠতো। কি বলবে, ভেবে না পেয়ে অনেকটা আড়ষ্ট বোধ করতো। অনামিকা যখন তার গল্প বলে যেত, অনন্ত শুনতে শুনতে ভেবে রাখতো, তার গল্প বলা শেষ হলে সে কী দিয়ে শুরু করবে। অনামিকার অনেক বন্ধু ছিল, নিছক বন্ধু, যাদের সান্নিধ্যে সে জীবনের এক বিরাট শূন্যতাকে ভুলে থাকতে চাইতো। অনন্তও বন্ধু বৎসল ছিল, তবে হৈহৈ করা বন্ধু নয়, পরিমিতিবোধ সম্পন্ন বন্ধুদের নিয়ে সে আড্ডা-আলাপচারিতা পছন্দ করতো। দু'জনের জীবনধারা দু'রকম ছিল, তবুও কোথায় যেন একটা মিলও ছিল। দু'জনই জীবনকে নিয়ে বেশ ভাবতো। দু’জনেরই একটা স্পর্শকাতর মন ছিল।
সে সময়ের এক বিখ্যাত মুভি দেখে বের হবার সময় অনন্তের সাথে অনামিকার পরিচয় ঘটেছিলো। তৃতীয় এক কমন বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয়। প্রথম দেখাতেই ভাল লেগেছিল, তেমনটি দু'জনের কারো মনে হয়নি, তবে ভালোলাগার একটু পরশ নিয়েই দু'জনে বাড়ী ফিরে এসেছিল। তাদের মেলামেশা খুবই সীমিত ছিল। আড়ালে আবডালে, টেলিফোনেই যা কিছু কথা। তখন কোন সেলফোন ছিলনা। অভিসারের সুযোগ সুবিধাও কম ছিল। অভিসার বলতে নীরবে নিভৃতে একটু সাক্ষাৎ আলাপচারিতা, একটু হাত ধরে হাঁটাহাঁটি, একত্রে ঝালমুড়ি খাওয়া, এসব আরকি। একদিন কয়েকঘন্টার অভিসার শেষে অনন্ত একটা থ্রী-হুইলারে করে অনামিকাকে তার বাড়ীতে পৌঁছে দিচ্ছিল। পথের বাতাসে অনামিকার চুপিসারে বলা কথাগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল, শুধু তার হাসিটুকু ছাড়া। অনামিকা নামার আগে অনন্ত’র হাতে একটা ছোট্ট ক্যাসেট দিয়ে বলে, এতে তার কিছু প্রিয় গান আছে। সেই এনালগ যুগে ফিতের ক্যাসেটই ছিল গান শোনার আর শোনাবার প্রচলিত মাধ্যম।
সেদিন অনন্ত খেয়াল করেছিল, অনামিকার খুব ঠান্ডা লেগেছে। গলা ফ্যাসফ্যাস করছে। সে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে অনামিকার গলায় পেঁচিয়ে দিয়েছিল। আর হাত বুলিয়ে অনামিকার উড়ন্ত চুলগুলোকে বশ মানাতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এসব কিছুই অনামিকা অভিভূতের ন্যায় উপভোগ করেছিল, কেননা এ রকম ভালবাসার ছোঁয়া সে জীবনে আর কখনো পায়নি। অনামিকাকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে একই থ্রী-হুইলারে করে অনন্ত ফিরে এসেছিল। ফিরে এসে অনন্ত অনেক রাত পর্যন্ত বিনিদ্র ছিল। বারবার তার চোখে ভেসে উঠছিলো অনামিকার ছোট্ট 'বাই বাই'।
এর কিছুদিন পরে অনন্ত বদলী হয়ে যায় দেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখান থেকে ট্রাঙ্ক কল বুকিং ছাড়া টেলিফোনে কথা বলা যেতনা। তাই শুরু হলো তাদের মধ্যে দৈনিক পত্র বিনিময়। অনামিকার হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর, cursive, টানা টানা। অনেকটা কবিগুরুর হাতের লেখার মত। অনন্ত’র টা ছিল গোটা গোটা, স্পষ্ট। ভাষা ছিল দু’জনেরই স্রোতস্বিনী ঝর্নাধারার মত, বাঁধনহারা। লেখার প্রতিটি বাক্যে গভীর আবেগ উপচে পড়তো। সে আবেগে দূর প্রবাসী (তখনকার দিনে ওটাই ছিল প্রবাসের মত) একলা অনন্ত একেবারে ভেসে যেত। হাবুডুবু খেতে খেতে আবার উঠে দাঁড়াতো।
সব ভালো কিছুর শেষ আছে। সে শেষটুকু খুব দ্রুত এসে যায়। দু’জনের জীবনের গতিধারায় আরো বিভিন্ন স্রোতের সমাবেশ ঘটতে থাকে। দৃষ্টির বাইরে মানে মনেরও বাইরে, কথাটাকে সত্য প্রমাণ করে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে পত্র বিনিময়ের পৌনঃপুনিকতা ক্রমান্বয়ে কমে আসে। আগে দৈনিক পত্র আসতো, তারপর সাপ্তাহিক, তারও পরে মাসিক কিংবা ত্রৈমাসিক। আবেগের জোয়ারেও ভাটা দেখা দিল। একদিন অনন্তকে হতবাক করে দিয়ে ডাকপিয়ন দিয়ে গেল নীল খামের ছোট্ট একটা ওজনহীন চিঠি- ‘আমাকে ভুলে যেও, প্লীজ!’ চিরশান্ত অনন্ত অশান্ত হয়ে উঠলো। মহকুমা শহরে গিয়ে ট্রাঙ্ক কল বুক করে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। অনেক কষ্টে লাইন পাওয়া গেলেও ওপার থেকে অনামিকা কথা বলতে চায় না। এভাবে নিরলস চেষ্টা তদবির করে যাবার পর একদিন অবশেষে অনন্ত অনামিকার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো। অনন্ত ভেবে রেখেছিলো, অনামিকা কথা বলতে চাইলে সে তাকে কিছু ঝারি দেয়া কথা শোনাবে। কিন্তু যখন কথা শুরু হল, অনন্ত বরাবরের মত শুধু শুনেই গেলো। একবার শুধু একটা বাজে কথা তার মুখ ফসকে বেরিয়েই গেলো। ঐ পরিস্থিতিতে বোধহয় ওটুকু খুব স্বাভাবিক ছিল, তাই অনামিকা এ নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া করেনি।
যেটা গল্পের শুরু হতে পারতো, সেটা হয়েছিল শেষ। সেই ছোট্ট 'বাই বাই' টাই যে ‘শেষ বাই বাই’ হবে, তখন শুধুমাত্র ভবিতব্য ছাড়া আর সেটা কে জানতো? অনন্তের চালক ছিল হৃদয়, আর অনামিকার, মস্তিষ্ক। ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনামিকা পৃথক পথ বেছে নিয়েছিল। অনন্ত খুব মুষঢ়ে পড়লেও, শেষমেষ নিজেকে সামলে নিতে পেরেছিল। সে মেনে নিয়েছিল, পৃথিবীতে সবকিছু সরল অংকে মিলেনা। মিললে আর যাদবের পাটিগণিতের প্রয়োজন থাকতোনা। জগত সংসারের সব কিছু সকল গতির মহা নিয়ন্ত্রকের ছক বাঁধা নিয়মে এগিয়ে চলে। জোয়ার ভাটার মত মানুষের জীবনে প্রেম আসে, প্রেম যায়। কোন কিছুই জোর করে আঁকড়ে ধরে থাকা যায় না। যে পথে যার যেখানে গন্তব্য, সে পথে সেখানে সে যাবেই। সৌরজগতের দুটি গ্রহের ন্যায় আজও তারা তাই আপন কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান। ঘুরতে ঘুরতে কখনো কাছে আসে, আবার প্রকৃতির নিয়মেই দূরে চলে যায়। তীব্র আকর্ষণে উভয়ে ধাবিত হলেও, তাদের গতিপথ সাংঘর্ষিক নয়, সমান্তরালও নয়।
অনামিকা এ নিয়ে অনেক ভেবেছে। সম্পর্কের যবনিকা নিজ হাতে টেনে দিলেও, অনন্তের রুমালটা সে যে টানা দু'বছর গলায় পেঁচিয়ে ঘুমাতো, একথা অনন্তকে তার আর কখনো বলা হয়নি। ফিতের ক্যাসেটটা এখন আর বাজাবার কোন উপায় না থাকলেও, অনন্ত মাঝে মাঝেই ইউ টিউবে খুঁজে নেয় সেই গান- “জিমি প্লীজ সে ইউ ওয়েইট ফর মি”…
সে সময়ের এক বিখ্যাত মুভি দেখে বের হবার সময় অনন্তের সাথে অনামিকার পরিচয় ঘটেছিলো। তৃতীয় এক কমন বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয়। প্রথম দেখাতেই ভাল লেগেছিল, তেমনটি দু'জনের কারো মনে হয়নি, তবে ভালোলাগার একটু পরশ নিয়েই দু'জনে বাড়ী ফিরে এসেছিল। তাদের মেলামেশা খুবই সীমিত ছিল। আড়ালে আবডালে, টেলিফোনেই যা কিছু কথা। তখন কোন সেলফোন ছিলনা। অভিসারের সুযোগ সুবিধাও কম ছিল। অভিসার বলতে নীরবে নিভৃতে একটু সাক্ষাৎ আলাপচারিতা, একটু হাত ধরে হাঁটাহাঁটি, একত্রে ঝালমুড়ি খাওয়া, এসব আরকি। একদিন কয়েকঘন্টার অভিসার শেষে অনন্ত একটা থ্রী-হুইলারে করে অনামিকাকে তার বাড়ীতে পৌঁছে দিচ্ছিল। পথের বাতাসে অনামিকার চুপিসারে বলা কথাগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল, শুধু তার হাসিটুকু ছাড়া। অনামিকা নামার আগে অনন্ত’র হাতে একটা ছোট্ট ক্যাসেট দিয়ে বলে, এতে তার কিছু প্রিয় গান আছে। সেই এনালগ যুগে ফিতের ক্যাসেটই ছিল গান শোনার আর শোনাবার প্রচলিত মাধ্যম।
সেদিন অনন্ত খেয়াল করেছিল, অনামিকার খুব ঠান্ডা লেগেছে। গলা ফ্যাসফ্যাস করছে। সে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে অনামিকার গলায় পেঁচিয়ে দিয়েছিল। আর হাত বুলিয়ে অনামিকার উড়ন্ত চুলগুলোকে বশ মানাতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এসব কিছুই অনামিকা অভিভূতের ন্যায় উপভোগ করেছিল, কেননা এ রকম ভালবাসার ছোঁয়া সে জীবনে আর কখনো পায়নি। অনামিকাকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে একই থ্রী-হুইলারে করে অনন্ত ফিরে এসেছিল। ফিরে এসে অনন্ত অনেক রাত পর্যন্ত বিনিদ্র ছিল। বারবার তার চোখে ভেসে উঠছিলো অনামিকার ছোট্ট 'বাই বাই'।
এর কিছুদিন পরে অনন্ত বদলী হয়ে যায় দেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখান থেকে ট্রাঙ্ক কল বুকিং ছাড়া টেলিফোনে কথা বলা যেতনা। তাই শুরু হলো তাদের মধ্যে দৈনিক পত্র বিনিময়। অনামিকার হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর, cursive, টানা টানা। অনেকটা কবিগুরুর হাতের লেখার মত। অনন্ত’র টা ছিল গোটা গোটা, স্পষ্ট। ভাষা ছিল দু’জনেরই স্রোতস্বিনী ঝর্নাধারার মত, বাঁধনহারা। লেখার প্রতিটি বাক্যে গভীর আবেগ উপচে পড়তো। সে আবেগে দূর প্রবাসী (তখনকার দিনে ওটাই ছিল প্রবাসের মত) একলা অনন্ত একেবারে ভেসে যেত। হাবুডুবু খেতে খেতে আবার উঠে দাঁড়াতো।
সব ভালো কিছুর শেষ আছে। সে শেষটুকু খুব দ্রুত এসে যায়। দু’জনের জীবনের গতিধারায় আরো বিভিন্ন স্রোতের সমাবেশ ঘটতে থাকে। দৃষ্টির বাইরে মানে মনেরও বাইরে, কথাটাকে সত্য প্রমাণ করে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে পত্র বিনিময়ের পৌনঃপুনিকতা ক্রমান্বয়ে কমে আসে। আগে দৈনিক পত্র আসতো, তারপর সাপ্তাহিক, তারও পরে মাসিক কিংবা ত্রৈমাসিক। আবেগের জোয়ারেও ভাটা দেখা দিল। একদিন অনন্তকে হতবাক করে দিয়ে ডাকপিয়ন দিয়ে গেল নীল খামের ছোট্ট একটা ওজনহীন চিঠি- ‘আমাকে ভুলে যেও, প্লীজ!’ চিরশান্ত অনন্ত অশান্ত হয়ে উঠলো। মহকুমা শহরে গিয়ে ট্রাঙ্ক কল বুক করে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। অনেক কষ্টে লাইন পাওয়া গেলেও ওপার থেকে অনামিকা কথা বলতে চায় না। এভাবে নিরলস চেষ্টা তদবির করে যাবার পর একদিন অবশেষে অনন্ত অনামিকার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো। অনন্ত ভেবে রেখেছিলো, অনামিকা কথা বলতে চাইলে সে তাকে কিছু ঝারি দেয়া কথা শোনাবে। কিন্তু যখন কথা শুরু হল, অনন্ত বরাবরের মত শুধু শুনেই গেলো। একবার শুধু একটা বাজে কথা তার মুখ ফসকে বেরিয়েই গেলো। ঐ পরিস্থিতিতে বোধহয় ওটুকু খুব স্বাভাবিক ছিল, তাই অনামিকা এ নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া করেনি।
যেটা গল্পের শুরু হতে পারতো, সেটা হয়েছিল শেষ। সেই ছোট্ট 'বাই বাই' টাই যে ‘শেষ বাই বাই’ হবে, তখন শুধুমাত্র ভবিতব্য ছাড়া আর সেটা কে জানতো? অনন্তের চালক ছিল হৃদয়, আর অনামিকার, মস্তিষ্ক। ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনামিকা পৃথক পথ বেছে নিয়েছিল। অনন্ত খুব মুষঢ়ে পড়লেও, শেষমেষ নিজেকে সামলে নিতে পেরেছিল। সে মেনে নিয়েছিল, পৃথিবীতে সবকিছু সরল অংকে মিলেনা। মিললে আর যাদবের পাটিগণিতের প্রয়োজন থাকতোনা। জগত সংসারের সব কিছু সকল গতির মহা নিয়ন্ত্রকের ছক বাঁধা নিয়মে এগিয়ে চলে। জোয়ার ভাটার মত মানুষের জীবনে প্রেম আসে, প্রেম যায়। কোন কিছুই জোর করে আঁকড়ে ধরে থাকা যায় না। যে পথে যার যেখানে গন্তব্য, সে পথে সেখানে সে যাবেই। সৌরজগতের দুটি গ্রহের ন্যায় আজও তারা তাই আপন কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান। ঘুরতে ঘুরতে কখনো কাছে আসে, আবার প্রকৃতির নিয়মেই দূরে চলে যায়। তীব্র আকর্ষণে উভয়ে ধাবিত হলেও, তাদের গতিপথ সাংঘর্ষিক নয়, সমান্তরালও নয়।
অনামিকা এ নিয়ে অনেক ভেবেছে। সম্পর্কের যবনিকা নিজ হাতে টেনে দিলেও, অনন্তের রুমালটা সে যে টানা দু'বছর গলায় পেঁচিয়ে ঘুমাতো, একথা অনন্তকে তার আর কখনো বলা হয়নি। ফিতের ক্যাসেটটা এখন আর বাজাবার কোন উপায় না থাকলেও, অনন্ত মাঝে মাঝেই ইউ টিউবে খুঁজে নেয় সেই গান- “জিমি প্লীজ সে ইউ ওয়েইট ফর মি”…
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন